Friday, August 28, 2020

কার স্বার্থে বহাল এসপি?




একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সিনহা হত্যার তদন্ত!!

সাইদুর রহমান রিমন:
এসপি মাসুদের নানা কৌশলী খবরদারিত্বে মেজর সিনহা হত্যার তদন্ত কী একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে? র্যাব কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি, অক্লান্ত পরিশ্রম, গোয়েন্দা ইউনিটের অব্যাহত তথ্য সহায়তা সত্তেও তদন্ত ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন না দেশবাসী। ‌'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে' শব্দের মধ্যেই র্যাবের প্রেসব্রিফিং সীমাবদ্ধ থাকায় হতাশ হয়ে পড়ছেন মামলা সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে হত্যাকান্ডের ২৮ দিন পেরিয়ে গেলেও মামলার প্রধান সাক্ষী সিফাতের বক্তব্য রেকর্ড করতে পারেননি র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা। অথচ তার বক্তব্য ছাড়াই আসামিদের দুই দফা রিমান্ড শেষ হয়েছে, তৃতীয় দফায় আরো তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে প্রদীপ-লিয়াকত-নন্দ দুলালকে। ফলে 'হত্যাকান্ড হয়েছে' এইমর্মে যাবতীয় তথ্য প্রমাণ জোগাড় করা গেছে কিন্তু 'কেন এ হত্যাকান্ড' সেই মোটিভ সম্পর্কে এখনো তদন্ত কর্মকর্তারা অন্ধকারে। 

র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সরাসরি স্বীকার না করলেও একাধিক সূত্রে জানা যায়, তদন্ত কর্মকান্ডের সকল পয়েন্টে কক্সবাজারের অভিযুক্ত পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদের নগ্ন হস্তক্ষেপ দেখতে পাচ্ছেন। তার বাড়তি প্রভাব আর নানা কৌশলী ভূমিকার কারণে পদে পদে বাধাগ্রস্তও হচ্ছে তদন্ত। ঘটনার দিন ওসি প্রদীপের সঙ্গি হয়ে আর কারা কারা উর্দ্ধশ্বাসে ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছেছিলেন তাদের তালিকাটা পর্যন্ত র্যাব কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তরে নানারকম গড়িমসি করা হচ্ছে। আবার ভিন্নসূত্রে তালিকা সংগ্রহ করা গেলেও তাদেরকে খুঁজে টেকনাফ থানায় পাওয়া যাচ্ছে না। কৌশলী এসপি এরইমধ্যে ঘটনাস্থলে যাওয়া দুই সাব ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলকে তাৎক্ষণিক ভাবে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। 
তদন্ত কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী এক র্যাব কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টেকনাফ থানার সিসিটিভি ফুটেজ ও হার্ডড্রাইভ গায়েব হওয়াটাই সিনহা হত্যার মূল মোটিভ উদঘাটনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি জানা সত্তেও এসপি যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। বরং তদন্ত কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করছে। তবে প্রদীপের স্বার্থ সুরক্ষার মিশন নিয়ে সদ্য দায়িত্ব পাওয়া ওসি ফয়সলকে ইতিমধ্যেই টেকনাফ থানার চেয়ার ছাড়া করা হয়েছে। তাকে এপিবিএন এ যোগদানে বাধ্য করা হয়েছে। 


ডাকাত হাকিমের হাতে ওসি প্রদীপের টাকা!

এবার রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিমের হাত ঘুরেই ওসি প্রদীপের কয়েক কোটি টাকা দুবাইতে পাচার হয়ে গেল। গত ৭২ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই ইয়াবা ডন ফয়সাল, সোহেল, রফিক ও জাফর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। 
সীমান্তের চোরাচালানী সিন্ডিকেট টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে ম্যানেজ করে এবং রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিমের সহযোগিতায় মিয়ানমার থেকে মরণনেশা ইয়াবার বড় বড় চালান আনার নেপথ্য কাহিনী ফাঁস হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকটি চালান র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হলেও তার চেয়ে বহুগুণ বেশি চালান ঢুকে পড়েছে দেশের অভ্যন্তরে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার মরিচ্যাঘোনা এলাকার দুই সহোদর ফয়সাল ও সোহেল, রফিক, রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। 
এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা শত শত কোটি টাকা দুবাইতে পাচার করছেন, এই পাচার করা টাকা দুবাইতে গ্রহণ করতেন মোঃ সোহেল। এই টাকায় সোহেল বিদেশে বিলাসবহুল গাড়ী, বাড়ি, মার্কেটসহ বহুতল ভবন নির্মাণ, ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছেন। এছাড়াও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশেও নানা সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন বলে তথ্য রয়েছে। একই এলাকার বিকাশ নামধারী হুন্ডি ব্যবসায়ী রফিকের মাধ্যমে দুবাইতে কোটি কোটি টাকা পাচার ছাড়া সরাসরি ইয়াবার চালান দুবাই নিয়ে খালাস করে বেশ কয়েকবার। ফয়সালের অপর ভাই সোহেল স্বপরিবারে বর্তমানে দুবাইতে অবস্থান করে। 


তবুও এসপি কার স্বার্থে বহাল?

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আলোচনায় আসে ওসি প্রদীপ দাশের অন্ধকার জগতের তথ্য। ক্রসফায়ার ‘বাণিজ্য’ ও মাদক ব্যবসায় মদত দেয়ার মাধ্যমে টাকা কামানোর নেশায় পরিণত হয়েছিল প্রদীপের। কিন্তু তিনি কী একাই এই কাজ করেছেন? না। তার সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনও।
ওসি প্রদীপ বা লিয়াকতের মতো কয়েকজনের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ এলেও তাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জেলা পুলিশ। অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ থাকতো কক্সবাজারের এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করার মাঝেই। তাদের কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সায় ছিল এসপি’র।

এসপি’র স্ত্রী জেনিফার মুনের নামে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়া ছাড়াও নামে-বেনামে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে।
বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণ ওলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের আব্দুল কাদের হাওলাদার ও অজুফা খাতুনের ছেলে এবিএম মাসুদ হোসেন ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেননি। শিবিরের একজন নেতার মাধ্যমে তিনি ইসলামী ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। জোট সরকারের আমলে ২৪তম বিসিএসে এএসপি হিসেবে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শ্বশুরের পরিচয়ে তিনি সুবিধা নেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য পেয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের ভাষ্যে উঠে এসেছে এসপি মাসুদের নানা অনিয়মের তথ্য। মূলত তার আশকারায় ওসি প্রদীপসহ একাধিক সদস্য বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন দিনের পর দিন। কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেয়া, বড় মাদক ব্যবসায়ীদের না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরা, ক্রসফায়ার বাণিজ্য, অভিজাত হোটেল থেকে চাঁদা আদায় ও সংশ্লিষ্ট জেলার জামায়াত নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের ভূমিকা নিয়েও।

No comments:

Post a Comment