শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরার দুটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। ঠিকাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালকের সিন্ডিকেট সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।
লাশ রাখার জন্য মোর্চুয়ারি ফ্রিজসহ ৪১টি আইটেম কেনায় কয়েকগুণ বেশি টাকা দেয়া হয় ঠিকাদারকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য এসব কেনা হয়।
সাতক্ষীরা মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এবং ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) জন্য কেনাকাটায় ৮০ শতাংশই লোপাট হয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির দিকে নজর দিয়েছি। আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। এসব দুর্নীতিও অনুসন্ধান এবং তদন্তে বেরিয়ে আসবে। জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ৪১ ধরনের পণ্য কেনা হয়। পণ্যের তালিকায় আছে মোর্চুয়ারি ফ্রিজ। পচনের হাত থেকে রক্ষার জন্য কয়েকদিন এ ধরনের ফ্রিজে লাশ রাখেন অনেকেই। অন্যান্য আইটেমের সঙ্গে লাশ রাখার এই ফ্রিজ কেনায় ৯১ গুণ বেশি টাকা ঠিকাদারকে দিয়ে পরে তা হাতিয়ে নেন জড়িতরা।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা দামের মোর্চুয়ারি ফ্রিজ ক্রয় করা হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকা দামে। একটি মোর্চুয়ারি ফ্রিজেই দুর্নীতি হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ধরনের কেনাকাটায় হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া একাই হাতিয়ে নেন ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এমন ভয়ংকর দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে।
অন্যদিকে, ঢাকার বাইরে দুটি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় লুটপাট হয়েছে। কীভাবে সেখানে দুর্নীতি হয়, তা জানতে সাতক্ষীরার দুটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান- সাতক্ষীরা মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এবং ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) প্রতি নজর দেয়া হয় যুগান্তরের পক্ষ থেকে।
এতে দেখা যায়, ওই দুটি প্রতিষ্ঠানেও কেনাকাটায় ৮০ শতাংশই হরিলুট হয়েছে। অনুসন্ধানে পাওয়া এ সংক্রান্ত অভিযোগ ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দুর্নীতির সত্যতা মিলেছে। বিভিন্ন ‘খাত’ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ও পরিচালক ডা. তওহীদুর রহমান দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই দুর্নীতিতে জড়ান।
এমন ঘটনাও ঘটেছে, কাঠযাতীয় সামগ্রী ও আসবাবপত্র ক্রয়ে পরিমাপ করে দুর্নীতি বের করতে গিয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তারাও ভাগ নিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও টিআইবির সাবেক ট্রাস্টি ও সুজন সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেক সময় অনুমান করে বলি দুর্নীতি হচ্ছে। অথচ অনুসন্ধানে অনুমানের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা ভয়ংকর। এটা কোনো সরকারি দফতরের জন্য সেবার নমুনা হতে পারে না। কতিপয় চেয়ারধারী ব্যক্তির পকেট ভারি করার একটা পাকা রাস্তা।
তিনি আরও বলেন, যারা দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধে সিরিয়াস অ্যাকশন হয় না বলে তারা সাহস পায়। তাদের জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপ হয়, তেমনি জনগণও সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে আমি মনে করি, এ ধরনের দুর্নীতিবাজদের বড় রকমের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। প্রয়োজনে দুদকের আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রের অর্থ তছরুপকারীদের বিরুদ্ধে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবনের সাজার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বড় সাজা হলেও দুর্নীতি করার আগে দুর্নীতিবাজরা কিছুটা ভাববে।
অনুসন্ধানকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেনাকাটার একটি তালিকা যুগান্তরের হাতে আসে।
এতে দেখা যায়, ওই দুই বছরেই পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া নিজের চেয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি করেন। সাজানো টেন্ডারের মাধ্যমে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেন। তাদের কার্যাদেশ দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নেন। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নির্ধারিত আর্থিক ক্ষমতাসীমার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের সীমাও ছাড়িয়ে যান।
এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে তার ‘ক্রয়ক্ষমতা’ না থাকলেও রাজস্ব, উন্নয়ন ও থোক বরাদ্দের অর্থ দিয়ে যন্ত্রপাতি কেনার বন্দোবস্ত করেন। তৈরি করেন নানারকম খাত। উল্লিখিত অর্থবছরে পৃথক দুটি উন্মুক্ত সাজানো দরপত্র আহ্বান করেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে যারা মেডিকেলের জন্য ভারি যন্ত্রপাতি আমদানিকারক, বিক্রয়কারী ও সরবরাহকারী, তাদের দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে তৃতীয় শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ঠিকাদারদের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের কর্নধার মুন্সী ফখরুল হোসাইন, মেসার্স আরসিএস-এর কর্ণধার রবিউল আলম ও মেসার্স এএসএল এন্টারপ্রাইজের আফতাব আহমেদকে বেছে নেন ওই পরিচালক।
বিল উত্তোলনের পর বাড়তি পুরো অর্থ তাকে ক্যাশ বা ডলারে পরিশোধ করতে হবে- এ ধরনের সমঝোতা করেন। পরিকল্পনামতো ওই দুটি প্রতিষ্ঠানকেই কাজ পাইয়ে দেন তিনি। বাজার দরের চেয়ে কোনোটি ৫০ গুণ আবার কোনোটি ৯০-৯১ গুণ বেশি দরে আইটেমভিত্তিক দর গ্রহণ করেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে তার বাছাই করা ওই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই কার্যাদেশ প্রদান করেন। পরে কায়দা করে ঠিকাদারকে দিয়ে বিলের নামে টাকা বের করে নেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া মুন্সী ফখরুল হোসেনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, রবিউল আলমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং আফতাব আহমেদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এই দুর্নীতিতে সহায়তা করেন তিন ঠিকাদার।
অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ২৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা দামের একটি অপারেটিভ হিস্টেরোস্কপি মেশিন ৯৬ লাখ টাকায় সরবরাহ করে। এই একটি মেশিন ক্রয়ে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত দেয়া হয় ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের প্রতিটি হাইফ্লো অক্সিজেন থেরাপি মেশিন ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা দরে ৫টির জন্য অতিরিক্ত বিল করা হয় ২৮ লাখ টাকা। ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের প্রতিটি হাইফ্লো অক্সিজেন মেশিন ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দামে ক্রয় করা হয়। ৬টিতে অতিরিক্ত বিল দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
৬ লাখ টাকা দামের প্রতিটি ইলেকট্রিক ডেন্টাল ইউনিট মেশিন ৩৩ লাখ টাকা করে ক্রয় করা হয়। ৫টি মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত বিল দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দামের প্রতিটি ওটি লাইট কেনা হয়েছে ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা করে।
এতে তিনটি ওটি লাইটে অতিরিক্ত বিল দেয়া হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এভাবে ৫টি আইটেমে একত্রে অতিরিক্ত বিল তুলে দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।
একইভাবে ওই অর্থ বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরসিএস এন্টারপ্রাইজের মালিক রবিউল আলমকে ফটোগ্রাফি মেশিন, শর্ট ওয়েভ মেশিন, টেবিল হস্ট, নিউরো সার্জারি মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রপাতি, মাইক্রো ওয়েভ, মোর্চুয়ারি ফ্রিজসহ ২৬টি আইটেমে অতিরিক্ত দেয়া হয় ১৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা।
একইভাবে ওই দুই অর্থবছরে অন্যান্য ১৫টি সামগ্রী ক্রয়ে বিলের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দামের বেবি ইনকিউবেটরের প্রতিটির বিল দেয়া হয়েছে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তিনটি বেবি ইনকিউবেটর জন্য বাড়তি টাকা দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা।
ফটোগ্রাফি মেশিনের দাম ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরসিএসকে দেয়া হয় ১৬ লাখ টাকা, ১২ লাখ ৫৫ হাজার টাকার শটওয়েভ মেশিনের দাম শোধ করা হয় ২৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ২৩ লাখ টাকা দামের তিনটি ডায়ালাইজার রিপ্রসেসিং মেশিন ক্রয় বাবদ অতিরিক্ত বিল দেয়া হয় ৯৩ লাখ টাকা।
২১ লাখ টাকা দামের কিডনি ডায়ালিসিস মেশিন ৪৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা করে ৬টি মেশিনে অতিরিক্ত বিল দেয়া হয় ১ কোটি ৪০ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ৩২ হাজার টাকা দামের তিনটি সিআরআর ফর আইসিও মেশিনের জন্য অতিরিক্ত বিল দেয়া হয় ৮৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একইভাবে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের ফিল্টার অপটিক ল্যারিংগোস্কোপ ২টি মেশিনের জন্য বাড়তি দেয়া হয় ৩৩ লাখ টাকা, ১৩ হাজার টাকা দামের বিআই পেপ অ্যান্ড সিপিএপির জন্য বাড়তি বিল দেয়া হয় ৮৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ১ কোটি ২২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা দামের নিউরোসার্জারি মাইক্রোস্কোপের বিল শোধ করা হয় ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
একটি মেশিনেই অতিরিক্ত দেয়া হয় ৭৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। ২২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা দামের ক্রাইয়োথেরাপি মেশিন ৫৬ লাখ, ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার পুভা মেশিন ৩২ লাখ টাকা, ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দামের মাইক্রোওয়েভ ২১ লাখ টাকা, ২২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা দামের টাইল টেবিল উইথ হোস্ট-এর বিল ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১২ লাখ টাকা দামের ইএনটি সার্জারি কবলেশন সিস্টেম বিল দেয়া হয় ৯৬ লাখ টাকা করে।
১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দামের কোবলেশন সিস্টেম সার্জারি আইটেমের বিল দেয়া হয় ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ৪ লাখ টাকা দামের কোয়ালিটি সিআরআর সিস্টেম ফিডবেচের দাম শোধ করা হয় ৭০ লাখ টাকা, ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের ডিফিকাল্ট এয়ারওয়ে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের বিল দেয়া হয় ৭১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা দামের ক্যাপনোগ্রাফ মনিটরের প্রতিটির বিল দেয়া হয় ৪২ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২টা মনিটরেই দুর্নীতি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দামের পেশেন্ট মনিটর ৫১ লাখ টাকা, ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দামের ডিএস ৩০০০ সিস্টেম পাম্প মডেলের মেশিন বাবদ অতিরিক্ত ৫১ লাখ টাকাসহ ২৬ ধরনের আইটেমের জন্য ১৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা বিল করে হাতিয়ে নেয়া হয়।
একইভাবে মেসার্স এএসএল নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৫টি মেডিকেল সরঞ্জাম কেনায় বাজারমূল্যের চেয়ে ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৩ হাজার টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়ে নেন ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া।
কয়েকটি সরঞ্জামের বিলের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ১ কোটি টাকা দামের ১০০০ এমএ ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের বিল দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, ৭৭ লাখ ১৯ হাজার টাকার সার্জিক্যাল ইএনটি অপারেশন জুম মাইক্রোস্কোপের দাম ১ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি মেশিনেই দুর্নীতি ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
একইভাবে ৫৬ লাখ টাকা দামের হাইডেফিনেশন এন্ডোর্সকপি মনিটরের দাম ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বিল করা হয়েছে। একটিতেই দুর্নীতি ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এভাবে ১৫টি আইটেম কেনাকাটায় প্রায় সোয়া ১৬ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে।
ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে দুই বছরের শুধু কেনাকাটা খাতেই ৩৬ কোটি টাকারও বেশি দুর্নীতির মিলেছে। এর বাইরেও তিনি নিয়োগ বদলি ও প্রশাসনিক কেনাকাটাসহ অন্যান্য খাতে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে জানা গেছে। তার এসব দুর্নীতির বিষয় সামনে এলে টাকার বিনিময়ে তিনি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, তিনি নিয়মের মধ্যে থেকেই সব কাজ করেছেন। এতে ভুল হতেও পারে। সব হাসপাতালেই একইভাবে কেনাকাট হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার হাসপাতালের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, সেটা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা দামের মোর্চুয়ারি ফ্রিজ ১ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেনার বিষয়ে টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন এমন একজন ঠিকাদার যুগান্তরকে বলেন, ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার মধ্যেও আমাদের ১০ পার্সেন্ট প্রফিট (লাভ) আছে। তাই আমরা সেই ‘প্রফিট’ হাতে রেখেই টেন্ডারে কত টাকায় কোন আইটেম সরবরাহ করব, তা দরপত্রের শর্তানুসারে উল্লেখ করে থাকি। এখানে যা হয়েছে তার তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ঠিকাদার রবিউল আলমের মাধ্যমে ১৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা দুর্নীতি হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সরকারের নিয়ম অনুসারে টেন্ডার পেয়েছি। যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছি। এতে দুর্নীতি হয়েছে কি না, বলতে পারব না।
তবে অপর একজন ঠিকাদার স্বীকার করেন, তার কাছ থেকে কাজ পাওয়ার আগেই চেক নিয়ে নেন পরিচালক। কাজ পাওয়ার পর বিল পেতে-না-পেতেই কখনও ক্যাশ, কখনও ডলারে তাকে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মুখ বন্ধ।
সাতক্ষীরার দুই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি : ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এবং ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে (আইএইচটি) কেনাকাটা ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে খাত বানিয়ে দুর্নীতি করেন ওই জেলার সাবেক সিভিল সার্জন প্রতিষ্ঠান দুটির সাবেক অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমান।
তিনিও সিন্ডিকেট করে সমঝোতার মাধ্যমে বেশকিছু আইটেমের নিম্নমানের পণ্য উচ্চমূল্যে কিনে নেয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেন। ২৬ কোটি টাকার কেনাকাটায় অন্তত ৮০ ভাগই তছরুপ হয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তওহীদুর রহমান ম্যাটস ও আইএইটি- এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ইকুইপমেন্ট সামগ্রী, আসবাবপত্র, বইপত্র এবং খেলাধুলাসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ম্যাটসের জন্য বইপত্র-সাময়িকী খাতে ১ কোটি টাকা, খেলাধুলার সামগ্রী খাতে ৫০ লাখ টাকা, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি খাতে ৫০ লাখ টাকা, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম খাতে ৫ কোটি টাকা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ খাতে ৫০ লাখ টাকা, আসবাবপত্র খাতে ২ কোটি টাকা, টেলিফোন ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম খাতে ৩ লাখ টাকা, একই তারিখের আরেকটি স্মারকমূলে বইপত্র ও সাময়িকী খাতে ২ কোটি টাকা, খেলাধুলা সামগ্রী খাতে ৫০ লাখ টাকা, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি খাতে ২০ লাখ টাকা, অন্যান্য সরঞ্জামাদি খাতে ১০ কোটি টাকা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ খাতে ১ কোটি টাকা, আসবাবপত্র খাতে ৩ কোটি টাকা, টেলিফোন সরঞ্জাম খাতে ৫০ লাখ টাকাসহ ২৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখা) বরাবর আবেদনটি ছিল নিয়মবহির্ভূতভাবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাহিদা বরাদ্দ প্রাপ্তির আগেই যথাযথ স্পেসিফিকেশন ছাড়া তওহীদুর রহমান ম্যাটসের ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদার্স এবং ফার্নিচার সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তিনটি লটে ভাগ করে দরপত্র জারি করেন। একইভাবে আইএইচটি-এর ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদার্স এবং ফার্নিচার সামগ্রী ক্রয়ের তিনটি লটে ভাগ করে আরেকটি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি জারি করেন।
ম্যাটস ও আইএইচটির এই খাতওয়ারি খরচের ক্ষেত্রে তওহীদুর রহমান বিধিবহির্ভূতভাবে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া বাজারদর কমিটি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও সার্ভে কমিটি গঠন করেন। তিনি কোনোরকম স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত ছাড়াই দরপত্র আহ্বান করেন।
তিনি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শেখ মোকাররম হোসেন ও মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ পরস্পর যোগসাজশে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে সাজানো দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটা ও সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ করেন। সাজানো দরপত্রে তিনি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খ-গ্রুপে (আসবাবপত্র) সরবরাহের জন্য বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ প্রদান করেন।
জানা গেছে, ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে কাঠের আসবাবপত্র সঠিকভাবে সরবরাহ করা হয়েছে কি না, নিশ্চিত হতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে গণপূর্ত অধিদফতরের কারখানা বিভাগের দুই উপসহকারী প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা পরিমাপ করতে গিয়ে ঠিকাদার ও অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি চাপা দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগের বিষয়ে সাবেক অধ্যক্ষ ও সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান বলেন, আমার সময়ে কেনাকাটা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত টিমের কাছেই আমি আমার বক্তব্য দিয়েছি। এর বাইরে তিনি আর কিছু বলতে চাননি।